বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : করোনা মোকাবিলায় প্রতিষেধক দেওয়া নিয়ে এবার রাজনীতি করার অভিযোগ উঠল পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে। বিতর্কটি তৈরি হয়েছে খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে।
রাজ্যের জেলাগুলির পুলিশ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মুখ্যমন্ত্রীর নামে একটি চিঠি দেওয়া হচ্ছে। সেই চিঠি ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে জেলায় পুলিশ–প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য দফতরেও। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমাদের সরকার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রাজ্যের সমস্ত মানুষের কাছে এই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।’ চিঠিতে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে করোনা যোদ্ধা এবং পরে রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে করোনা ভাইরাস টিকা দেওয়া হবে। আর সেখানেই তৈরি হয়েছে প্রশ্ন। ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারের এমন দাবির বিরোধিতায় সরব হয়েছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় সরকার টিকা দিলেও মুখ্যমন্ত্রী আদতে মিথ্যে ঘোষণা করে চলেছেন বলেই টুইটে দাবি বাংলায় বিজেপির সহকারী পর্যবেক্ষক অমিত মালব্য। রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারীও।
উল্লেখ্য, ১৬ জানুয়ারি থেকে সারা ভারতেই কোভিডের টিকাকরণ শুরু হচ্ছে। শনিবার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে একটি পর্যালোচনা বৈঠক হয়। তার পরই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে ঘোষণা করা হয়, দেশের মোট ৩ কোটি ফ্রন্টলাইনার (করোনা যোদ্ধা) পুলিশ এবং চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। তার পর আরও ২৭ কোটি নাগরিককে (প্রবীণ) বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রীর নামে এমন চিঠি কী করে রাজ্য সরকারের তরফে পুলিশ এবং চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাঠানো হচ্ছে। কেন না, সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ ভ্যাকসিন এবং ভারত বায়োটেকের তৈরি ‘কোভ্যাক্সিন’ ভ্যাকসিনের পুরোটাই রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কোনও রাজ্য সরকারের কাছে তা নেই।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়ার জন্য তাঁদের সংখ্যা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারই নির্দিষ্ট সংখ্যক ভ্যাকসিন রাজ্যগুলিকে দেবে। রাজ্যের কাজ শুধু সেই টিকা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং টিকাকরণে সাহায্য করা। টিকার জন্য রাজ্যের কোনও খরচই হবে না। ৩ কোটি পুলিশ, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দিতে যে খরচ হবে, তা কেন্দ্রীয় সরকারই বহন করবে। তাই গোল বেঁধেছে মুখ্যমন্ত্রীর নামে লেখা চিঠির বক্তব্যে। সেখানে বলা হয়েছে, তৃণমূল সরকার বিনামূল্যে রাজ্যের মানুষের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছে দেবে। এর মধ্যেই সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকও রয়েছে সমস্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের। তার আগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করোনা যোদ্ধাদের যে চিঠি লিখেছেন, তা টিকাকরণে রাজ্য সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
এর আগে লকডাউন পর্বে করোনা মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলার প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দলই প্রশ্ন তুলেছে। করোনা সংক্রমিতের প্রকৃত সংখ্যা, কোমর্বিডিটির কারণ দেখিয়ে সংক্রমিতের মৃত্যু সংখ্যা কম করে দেখানোর অভিযোগও তারা বারবার রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে করেছে। এমনকী, লকডাউন কার্যকর করা নিয়েও স্থান বিশেষে ধর্ম ও নানা কারণে রাজ্য সরকার ও প্রশাসন বৈষম্য দেখিয়েছে বলেও বহুবার অভিযোগ উঠেছে। এর পর এবার সংক্রমণ বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় সরকারের টিকাকরণ কর্মসূচি নিয়েও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতি করার অভিযোগ উঠল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ ভাবে চিঠি লিখে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার দাবি করার তীব্র সমালোচনা করেছেন বাংলায় বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক অমিত মালব্য। তিনি বলেছেন, ‘রাজ্য সরকার প্রথমসারির করোনা যোদ্ধাদের বিনামূল্যে টিকাকরণের বন্দোবস্ত করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যে। তৃণমূল কর্মী–সমর্থকরা সে কথা প্রচার করতে বিভিন্ন প্রান্তে পোস্টার টাঙানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আসলে সাধারণ মানুষকে মূর্খ মনে করে রাজ্য সরকার এবং শাসক দল। তাই তারা ভাবে, তারা যা বলবে, তা সাধারণ মানুষ বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে।’ এর আগে তিনি একটি টুইট করেন। সেখানে লিখেছেন, ‘রাজ্যবাসীর জন্য বিনামূল্যে টিকাকরণের বন্দোবস্ত করেছেন পিসি! এমন নির্লজ্জতার কোনও সীমা নেই।’
মালব্য আরও লিখেছেন, ‘করোনা মোকাবিলায়ও এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক আপত্তিকর পদক্ষেপ করেছিলেন। এই বিষয়ে তখন চিকিৎসক থেকে পুলিশ, সবাই প্রতিবাদ করেছিলেন। জানি না তাঁর আজ সে–সব কথা মনে আছে কিনা! আর এখন কেন্দ্রীয় সরকারের বিনামূল্যে দেওয়া কোভিড ভ্যাকসিনের কৃতিত্ব নিতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন!’ বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীও। পুরুলিয়ার কাশীপুরে একটি সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এখন তো মনে হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার বিনামূল্যে যে ভ্যাকসিন দেবে, তাকে রাজ্যের তৃণমূল সরকার ‘টিকাশ্রী’ প্রকল্প বলেও চালিয়ে দিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্পূর্ণ মিথ্যেবাদী। কেন্দ্রের প্রকল্পগুলিকে নাম পাল্টে বেমালুম নিজেদের নামে চালিয়ে দেওয়ার কাজ এই সরকার হরবখতই করে থাকে।’